লাল গোলাপ
মোঃজমির হোসেন পারভেজ
'ঘরের ভিতর কেউ আছেন গো'
কে ডাকছে?
আমি ভিখারিনী সুফিয়া।
গৃহকর্তৃ দরজার সামনে এসে ভিখারিনী কে দেখলেন, দেখে বললেন, 'মাসাল্লাহ্,
গায়ের লছন-বছনে পাঁচ জনেন মধ্যে একজন। এমন শরীর নিয়ে কেউ কি ভিক্ষা করতে
আসে। কত বাড়িতে কত কাজই না পড়ে আছে, তা করলেইতো জীবন বাঁচে। সুফিয়া মনে
রাগ না নিয়ে বলল, 'মা' কাজ কি সবার বাড়িতে পাওয়া যায়,পাওয়া যায়না।
যদি আপনার বাড়িতে কাজ থাকে আমাকে রাখতে পারেন, আমি কাজ করব। গৃহকর্তৃ নাক
উঁচু করে বললেন, 'আমার কোন লোকের প্রয়োজন নেই। যাও যাও, অনত্রে চলে যাও।
সুফিয়া অন্য বাড়িতে চলে গেল।
'ঘরের মধ্যে কেউ আছেন গো 'মা '।
কে?
আমি ভিখারিনী সুফিয়া।
গৃহের কর্তা এগিয়ে এসে বললেন, সুস্থ মহিলা ভিক্ষা কর শরম করেনা। আমি হলেতো
লজ্জায় গলায় ফাঁসি লাগিয়ে মরে যেতাম। সুফিয়া বলল,সাহেব গো আজ আপনার
টাকা আছে একথা জোর দিয়ে বলছেন। যদি আপনার অবস্থা আমার অবস্থানে হতো তাহলে
একথা বলতে পারতেন না। আমি শুধু আমার নিজের পেট ভরার জন্য ভিক্ষে করিনি।
আমার সন্তান কে পড়া-লেখা করিয়ে মানুষ করার জন্যে ভিক্ষে করি। আমার জীবন
যত ঘৃনারই হোকনা কেন, আমার সন্তানের জীবন যাতে ঘৃনার না হয়। আর শিক্ষা
হিংসা, ঘৃনা,বিদ্বেষ,স্বমূলে ধ্বংস করে দিয়ে প্রকৃত মানুষ হতে শেখায়।
কোন ক্লাশে পড়ে তোমার ছেলে?
'বি.এ অনার্সের ফাইনাল বর্ষে'।
ছাত্র ভাল
'ছাত্র ভাল নাহলে কী ছেলে বি.এ অনার্সের ফাইনাল বর্ষে পড়ে '।
এমন সময় গৃহকর্তৃ এসে বললেন এই মহিলা কে এত প্রশ্ন করছ কেন। নিজেতো
সন্তানদের মানুষ হতে দিলেনা। ক্লাশ পঞ্চম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় ছেলে
মেয়ের পড়া-লেখা বন্ধ করিয়ে দিলে। তোমার কি টাকা পয়সার অভাব ছিল যে
সম্পত্তি আছেতা সাত জনমে ও শেষ হবেনা। কথায় আছে না, রতনে রতন চিনে শোকরে
চিনে কচু। তুমি গেয়োআনাড়ি টাকাই চিনলে, শিক্ষার মূল্য বুঝলেনা। এক একটি
শিক্ষিক নারী-পুরুষ এক একটি গোলাপ। গোলাপ গাছ নর্দমার মাঝেই জন্মাক কিংবা
সাজিয়েরাখা যত্নের টবের মধ্যেই জন্মাক।সেটা লাল গোলাপ হোক বা সাদা গোলাপ
হোক, তার গন্ধের মধ্যে তারতম্য থাকেনা। তবে সুফিয়ার ছেলে একটা লাল গোলাপ।
সূর্যের মত সকাল বেলা লাল হয়ে উদয় জয় এবং লাল হয়ে অস্ত যাবে। গৃহ কর্তা
সবসময় আনাড়ি মানুষদের সাথেই চলেছে। উঠা বসা করেছে। তাই শিক্ষার কদর
বুঝতে পারেনি। তাই হৃহ কর্তা সুফিয়াকে বললেন,
'তুমি কত ক্লাশ পড়েছ'?
'অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত'।
আর পড়নি কেন?
'বাবা আপনার মতই আনাড়ি ছিলেন। শিক্ষার মূল্য দিতেন না। তিনি বলতেন মেয়ে
মানুষ পড়া-লেখা করে কি করবে। আমার ইচ্ছা থাকা সত্তেও পড়া-লেখা বন্ধ করে
দেয়। তাই আর পড়তে পারিনি। আমার সহপাঠি রোকিয়া আই এ পাস করে একজন
প্রাইমারী শিক্ষিকা। হোসনেয়ারা অনার্স করে হাইস্কুল শিক্ষিকা। মহিনা বি.এ
পাস করে প্রাইমারী শিক্ষিকা। তাই নিজের বুকে ইচ্চ শিক্ষা করার ইচ্ছার
জ্বালা ধীরে ধীরে ভেতরটাকে পুড়ে কয়লায় পরিণত করছিল, তাই শত লাঞ্চনার
মধ্যে ও সন্তান কে প্রকৃত মানুষ করে মরতে চাই। গৃহ কর্তা বললেন, আল্লাহ
তোমার ইচ্ছা পূরণ করুক এই কামনাই করি। গৃহ কর্তা স্ত্রী সুলতানাকে বলল,
সুফিয়া কামাল কে এক হাজার টাকা দিয়ে দাও। ও আমার চোখের পর্দা খুলে
দিয়েছে। আমি আমার দুই ছেলেকে আবার স্কুলে ভর্তি করাব। গৃহ কর্তৃ সুলতানার
হাত এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, বোন, আমি তোমার সৎ ইচ্ছাকে সম্মান করি,
সম্মান করি তোমার স্বার্থক মাকে '।
তাহলে বোন এবার আসি। সুফিয়া বলল।
হু আস '।
সুফিয়া চলে গেল অন্য বাড়িতে। বাড়িটা সাজানো গোছানো। চার ভিটে চারটি
টিননেট ঘর। সবার এক ঘরের মধ্যে খানার ব্যবস্থা বোধ করি। যাকে যৌথ পরিবার
বলে। এখন যৌথ পরিবার সচারাচর দোখা যায়না। ভিখারীরা প্রতিটি গ্রামের
প্রতিটি পরিবারের আচার -আচরণ বুঝতে পারে। কেননা তাদের সাথে মানুষের আচরণ
ধারাই মানিষের জীবন প্রণালি বুঝা যায়। কেউ নম্র প্রকৃতির। কেউ ধূর্ত
প্রকৃতির। কেউ বদ মিজাজের। আবার কেউ হিংসাবিদ্বেষে প্রকৃতির। সুফিয়া এই
বাড়ির অভ্যন্তরে ডুকেই বলল, 'ঘরের ভেতরে কেউ আছেন গো মা।
ঘরের ভেতর থেকে অর্ধ বয়স্কা নারী বের হয়ে বললেন, 'কে তুমি'?
'আমি ভিখারিনী সুফিয়া '।
'কোন গ্রামে বাড়ি'?
'খরিয়ালা গ্রামে'।
'ঠিক আছে দাঁড়াও,আমি ভিক্ষা নিয়ে আসছি'?
'শুন মা, ভিক্ষা আমার পেশা নয়। আমার ছেলে এবছর ব্রাক্ষণবাড়িয়া সরকারী
কলেজে বি.এ অনার্সের ফাইনাল বর্ষের ছাত্র।ছেলের পরীক্ষার ফির টাকার জন্যে
ভিক্ষা করতে এসেছি, যদি পারেন একশত টাকা দিবেন।
'এটাকি তোমার প্রফেশন '?
'জ্বিনা '।
তুমি ইংরেজী বুঝ'?
'ছেলে যখন শিক্ষক, সা তো টুকটাক ইংরেজী বুঝবেই '।
'অনেক মহিলারাই তো মেয়েরবিয়ে, ছেলের পড়ালেখা,স্বামীর অসুখ ইত্যাদির কথা
বলে ভিক্ষার চাল বেশি বেশি কামায়। তুমি কি তাতের দলের? সুফিয়া স্পষ্ট
ভাষায় বলল, ওদের কথা জানিনা, সিথ্যা কথা বলে জীবন যাপন করার মধ্যে কোন সুখ
নেই। সৎ পথের এক মুঠো চাল, একটি টাকা, স্বর্গের আসবাব পত্র কিংবাসুস্বাদ
ফল মনে হয়। গৃহ কর্তৃ নাজমা চৌধুরি বললেন, তোমার কথায় দার্শনিকতার ছোয়া
আছে। সবাই মূল্য বান যুক্তি দেখিয়ে ভিক্ষা করে। বিভিন্ন প্রকারনা মূলক
কার্যেও আশ্রয় নিয়ে ভিক্ষা বৃত্তি করে থাকে, তাই এখন কোন কিছু বড় দান
করতে হলে প্রমান সাপেক্ষ দান করতে হয়। নাজমা চৌধুরি সুইটি নামের ভাসুর ঝি
কে ডাকলেন, বললেন,আমার এই ভাসুর ঝি ব্রাক্ষণবাড়িয়া সরকারী কলেজের বি.এ
অনার্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী,নাম সুইটি আক্তার। সুইটি তুমি এই মহিলার
ছেলে কে চিন?'
এক ভিখারিনীর ছেলে কে আমি কি করে চিনব'
আপনার ছেলের নাম কি? কি করে। '
"শ্রাবন "। ব্রাক্ষণবাড়িয়া সরকারী কলেজের ফাইনাল বর্ষের ছাত্র।
'শ্রাবন ভাই আপনার ছেলে। ইম্পুসিবল।শ্রাবন ভাই অতি টেলেন্ট ছাত্র। দেখতে
পোষাক আসাকে জমিদারের পুত্র। গ্রাম খড়িয়ালা। শ্রাবন ভাই আপনার মত
ভিখারিনীর ছেলে হতে পারেনা। তার ভাষা, আচরণ,কবিতা আবৃত্তি,অনুষ্ঠানের
বক্তৃতা সবই নাম করা রাজনীতিবিদের সন্তানের মত মনে হয়। চাচী মা, মানুষের
সুখের আড়ালে আকাশ চুম্বি দুঃখ লুকিয়ে থাকে জানতামনা, এই কথা বলে সুইটি
অশ্রু সংবরণ করে চলে গেল।
নাজমা চৌধুরি সুফিয়াকে বললেন, ছেলে পাস করে কি করবে? অনেক বিত্তবান দের ছেলেই তো অনার্স পাশ করে বেকার জীবন
যাপন করেছে? তোমার ছেলেও তাদের মধ্যেই পড়বে। সুফিয়া আত্নবিশ্বাস ভরা বুকে
বলল,'যারা বেকার তারা বোধ করি প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করেনি। যারা প্রকৃত
শিক্ষা অর্জন করে তার যোগ্যতা সাপেক্ষ চাকরি পাবেই। আমার ছেলের বড় চাকরির
প্রয়োজন নেই। একজন সরকারি প্রাইমারী শিক্ষিক হলেই চলবে। খড়িয়ালা গ্রামের
ছেলে-মেয়েদের যেন প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে খাটি মানুষ করে গড়ে তুলতে পারে।
সেই ছেলে মেয়েরা খাঁটি মানুষ হলেই খড়িয়ালা গ্রাম হবে একদিন আর্দশ গ্রাম।
আর সেই আর্দশ গ্রামই হবে আমার ছেলের পরশে।
'আর তুমি হবে সেই আর্দশ গ্রাম গড়ার জননী। '
তা জানিনা। '
'সুফিয়া,তোমার সৎ ইচ্ছাকে আর তোমাকে আমি স্যালুট করি। তোমার মাঝে যে
স্বপ্ন উদয় হয়েছে তা কোটি পতির স্ত্রীর মাঝে ও উদয় হয়না। তাতের মাঝে
উদয় হয় ভোগ বিলাসীতার। আমার শাশুড়িও অল্প শিক্ষিত হয়েও বিধবা অবস্থায়
চার ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে মানুষের মত মানুষ করেছে। তাই আমাদের
পরিবার শিক্ষিত পরিবার। চাকরি জীবী পরিবার। সেই জন্যেই দার্শনিক নেপুলিয়ন
বলেছেন -অামাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব। '
নাজমা চৌধুরি ঘরের ভেতর থেকে এসে বললেন, আপনার খড়িয়ালা গ্রামকে আদর্শ
গ্রাম করার জন্য আপনার সাথে শরীক হলাম পাঁচ হাজার টাকা শ্রাবনের পরীক্ষার
ফি দিয়ে।
সুফিয়া বুঝতে পারল, পৃথিবী যেরুপ বিচিত্রময় তেমনি তার মানুষ গুলো। নাজমা চৌধুরির ব্যবহার, অর্থদান সবই দেশপ্রেমের মনুষ্যত্ত্বের।
সমাপ্ত।